শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৭:০৩ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী লোক হলেও সময়ের ব্যবধানে সেই প্রভাবশালী লোককে সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হতে হয়েছে। তাকে এখন সাধারণ মানুষের মুখ থেকে চোর গালি শুনতে হয়। সেই সাথে নানা অপমান মূলক কথা শুনতে হয়। যার কথা বলা হচ্ছিলো তিনি হলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় দায়ের করা স্কুল ছাত্র রোমান হত্যা মামলায় নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আদালতপাড়া আইনজীবীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গোলাম দস্তগীর গাজীকে যখন রিমাণ্ড শুনানীর সময়ে আদালতে তোলা হচ্ছিলো তখন কেউ কেউ তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন ‘ওই যে চোর যাইতেছে। চোর যাইতেছে। মানুষের সম্পত্তি দখল করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ১৬ বছর মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করছে। তার কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার।’ আইনজীবীদের কেউ কেউ ওই সময় বলছিলেন, সময় মানুষ কে কোথায় নিয়ে যায়। মানুষ শিক্ষা নেয় না। গাজীকে দেশে মানুষের শিক্ষা নেয়া উচিত। এর আগে গত ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ আদালতে উঠানোর সময়ে বিক্ষুদ্ধ জনতা নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর উপর ডিম নিক্ষেপ করে বিক্ষুদ্ধ জনতা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে এই আদালতের কাছেই অবস্থিত সার্কিট হাউজে গোলাম দস্তগীর গাজীকে গার্ড অব অনার দেয়া হতো। বর্তমানে সেই সার্কিট হাউজের কাছেই তাকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উঠানো হয়। অথচ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার একজন প্রভাবশালী এমপি ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী।
যিনি নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে একটানা চারবারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ছিলেন। যার কথায় একসময় প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বমহলেই উঠ-বস করতো। তিনি যা বলতেন তাই হতো। তার কথার বাইরে যাওয়ার মতো কারও সাধ্য ছিলো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও দেশত্যাগ করেন। আর এই পতন ও দেশত্যাগের পর থেকেই সারাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। সারাদেশেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত পাওয়া নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী আড়াল হয়ে যান। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে যার অনুসারীর কোনো অভাব ছিলো না। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যে কোনো সভা সমাবেশে তিনি নজর কাড়তেন। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়ার সাথে সাথেই গোলাম দস্তগীর গাজীর অনুসারীরা উধাও হয়ে গেছেন। তার বাড়ি-ঘর কল কারখানা সাধারণ মানুষজন লুটপাট করে নিয়ে গেছে অথচ কেউ বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। গত ৫ আগস্টের পর থেকে রূপগঞ্জের খাদুন এলাকার গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার্স কারখানায় লোকজন লুটপাট করা শুরু করেন। সেই সাথে গোলাম দস্তগীর গাজী গত ২৫ আগস্ট ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। গোলাম দস্তগীরের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে গত ২৬ আগস্ট সোমবার দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করেন। রাত নয়টার সময় বিদ্যুৎহীন অন্ধকার ছয়তলা ভবনটিতে শত শত লোক লুটপাট চালাতে থাকেন। লুটপাটের এক পর্যায়ে কে বা কারা ভবনের নিচতলায় সিঁড়ির মুখে আগুন দিয়ে দেন। সেই সাথে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা টানা ৩২ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আর এই সময়ে কারখানার ভিতরে থাকা সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কারখানাটিতে অবশিষ্ট আর কিছুই নেই।
স্থানীয়রা বলেছেন, গাজীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখালে ভাগ্যে জুটতো মামলা, হামলা আর শারীরিক নির্যাতন। জমি দখল ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে খুন-গুমের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। সরকারি-বেসরকারি সব স্থাপনায় তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নামকরণ করেছেন। কোথাও আবাদি জমি ও বসতভিটা দখল করে গাজী গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। করছেন আবাসন প্রকল্পও। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারকেও। গাজীর রোষানল থেকে বাদ পড়েননি স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। একই সাথে দলীয় পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও কম যায়নি গাজী পরিবার। মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে একই পরিবারে বাবা মন্ত্রী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ছেলে সিনিয়র সহসভাপতি, মা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র পদ দখল করে ছিলেন।