সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:১০ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি,ঢাকাঃ দেশের একমাত্র লাভজনক চিনিকল দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানীর বর্তমান এমডি রাব্বিক হাসানের চারপাশ ঘিরে ওই এলাকার পলাতক এমপি হাজী আলী আজগর টগরের পেতাত্মারা এখনো স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।লক্ষ হাজার কোটি টাকা পাচারের দায়ে পলাতক শেখ হাসিনা সরকার ও শেখ রেহেনার কাছের মানুষ এমপি আলী আজগর টগরের রাম রাজত্বের অবসান হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। তবে টগরের পেতাত্মারা এখনো স্বমহিমায় উদ্ভাসিত, সক্রিয়। কিছুদিন আগে এমডি রাব্বিক হাসান যোগদানের পর সাধারণ শ্রমিক কর্মচারী ও এলাকাবাসী মনে করেছিলো সুশিক্ষিত এমডি রাব্বিক হাসান যোগদান করলে পাল্টে যাবে দুর্নীতিগ্রস্থ কেরুর চিরচেনা দৃশ্যপট। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বা বলা চলে এমডি রাব্বিক হাসানের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানী।ফলে বিতর্কীত নেতা-কর্মী ও শ্রমিক কর্মকর্তাদের অভিভাবক হিসেবে রাব্বিক
হাসান একের পর এক যেভাবে পলাতক এমপি টগরের লোকজনকে মাথায় তুলে নাছছেন, তা দেখে সাধারণ মানুুষ বাকরুদ্ধ-হতভম্ব। খোজ নিয়ে দেখা গেছে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর এমডি রাব্বিক হাসান দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানীর দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন।এর আগে টানা দেড়যুগ লোকনাথপুর দর্শনার বাসিন্দা চুয়াডাঙ্গা দুই আসনের বিনাভোটের এমপি হাজী আলী আজগার টগর, তার সহোদর দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মনসুর বাবু ওরফে গোল্ডেন বাবু
ওরফে ইয়াবা বাবু কেরুর শ্রমিক নিয়োগ, জমি লিজ, টেন্ডার, মদ ডিস্ট্রিবিউটসহ সার্বিক বিষয়ে নিজস্ব ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৎকালীন এমডিদের কাঠের পুতুলে পরিণত করে রেখেছিলো। এমপি টগর ও তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান ইয়াবা বাবু তার বাহিনী দিয়ে দর্শনা কেরু নিয়ন্ত্রনসহ দর্শনা কেরু থেকে সুকৌশলে প্রতিবছর হাতিয়ে নেন শতশত কোটি টাকা। এমপি টগর ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুর হয়ে
দর্শনা কেরুতে সে সময় ছড়ি ঘুড়াতেন সদ্য রিটায়ার্ড প্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ, সাবেক পৌর কাউন্সিলর জয়নাল আবেদিন নফর, সাংবাদিক ইয়াসির আরাফাত মিলন, শেখ আসলাম আলী তোতা, বিশিষ্ট চোরাকারবারী আব্দুল মান্নানসহ কতিপয় ব্যক্তিবর্গ।
সবাই ভেবেছিলো এমডি মোশাররফ হোসেনের বদলির পর এমডি রাব্বিক হাসানের যোগদানের মধ্য দিয়ে এমডি টগরের পেতাত্মার আছড় থেকে রক্ষা পাবে দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানী। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কেরুর বিষয়ে সার্বিক জ্ঞান না থাকায় সেক্রেটারী মাসুদ, নফর, সাংবাদিক ইয়াসির আরাফাত মিলন ও মিলনের ওস্তাদ তারকা সাংবাদিক সজীব আকবরকে দিয়ে বেশকিছু পজেটিভ রিপোর্ট ছাপিয়ে এমডি রাব্বিক হাসান দর্শনায় থিতু হওয়ার পরিকল্পনা করেন। ফলে সকাল থেকে সন্ধ্যা তার চারপাশে মামুন, নফর, মিলনের পেতাত্মারা সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে কেরুকে বিতর্কীত স্থানে পৌছে দেন। আর এর ফলে এসব বক্তিদের হেফাজতে থাকা শতশত বিঘা জমি, মার্কেট, পুকুর, কৃষি জমি দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানীর অনুকূলে জমা না করে বর্তমান এমডি রাব্বিক হাসান ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেন। আর তাই চলতি বছরেও কেরুর সমূদয় জমি রাব্বিক হাসান উদ্ধার করতে না পারায় এবারো আখ মাড়াই মৌসুম মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়বে বলে সচেতন মহল মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৮০৫ সালে মিঃ জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামক স্থানে তখনকার একমাত্র মদের কারকানাটি চালু করেছিলেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে এর নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিবর্তিত ও
পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মিঃ রবার্ট রাসেল অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঐ প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা ক্রয় করে নেন। উত্তর ভারতের “রোজা” তে অবস্থানকালিন ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অতঃপর তা পূনঃনির্মাণ পূর্বক জয়েন্ট স্টক কোম্পানী গঠন করে “কেরু এ্যান্ড কোং লিঃ” হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয। “রোজা”তে ব্যবসার উন্নিতি লাভ করলে
আসানসোল ওকাটনীতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয। ১৯৩৮সনে প্রাথমিক ভাবে দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ১৮,০০০ প্রূফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরও একটি শাখা তদানীন্তন নদীয়া জেলার অন্তর্গত এই দর্শনাতে স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর এটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিনত হয়। ১৯৬৮ সালে কেরু এ্যান্ড কোং (পাকিস্তান) লিঃ নামে আত্ম-প্রকাশ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয় এবং তখন থেকে অন্যবিধি এটি কেরু এ্যান্ড কোং
(বাংলাদেশ) লিঃ নামে বাংলাদেশ সুগার এ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীন পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৩৮ সালে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের অধীনে স্থাপিত হয়। সে সময় এর অধীনে একটি চিনি কারখানা, একটি ডিষ্টিলারী ইউনিট ও একটি ওষুধ কারখানা যাত্রা শুরু করে।[১] স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।
এই বৃহদায়তন শিল্প-কমপ্লেক্সটি চিনি কারখানা, ডিষ্টিলারি ওয়াটার,বাণিজ্যিক খামার ও জৈব সারকারখানার সমন্বয়ে গঠিত। এর ভুমির পরিমাণ ৩ হাজার ৫৭২ একর। যার ২ হাজার ৪৫০ একর কৃষিজমি। এসব কৃষিজমিতে আখ চাষ করা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় কেরু এ্যান্ড কোং(বাংলাদেশ) লিঃ এর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ছিল ১০১৬ মেট্রিক টন। জাতীয়করণের পরে ১৯৭৮-৮৫ সাল এই সময়ে অস্ট্রেলীয় কারিগরি সহযোগিতায় এর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫০ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন ক্ষমতা প্রতি অর্থবছরে ১১৫০ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার প্রুফ লিটার মদ বিক্রি করে কোম্পানিটি এবং আয় করেছে প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকা। এতে করে তার নিট (প্রকৃত) মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা বেশি। এখানকার মূল পণ্য হচ্ছে আখ থেকে উৎপাদিত চিনি। তবে আখ থেকে চিনি বের করে নেওয়ার পর যে
উপজাত-দ্রব্য (চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড) পাওয়া যায় তা থেকেও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হয়। উপজাত-দ্রব্য হতে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছে দেশি মদ, বিদেশি মদ, ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার এবং নতুন উৎপাদিত পণ্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এখানে নয়টি ব্র্যান্ডের ‘ফরেন লিকার’ বা বিদেশি মদ তৈরি হয়। ফরেন লিকারগুলো হচ্ছেঃ ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি,চেরি ব্র্যান্ডি,ইমপেরিয়াল হুইস্কি অরেঞ্জ ক্রেকাউট,সারিনা ভদকা,রোজা রাম,ওল্ড রাম।
এই ফরেন লিকার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দর্শনায় কেরুর নিজস্ব নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র হতে ১৮০, ৩৭৫ ও ৭৫০ মিঃলিঃ লিটারের বোতলে বাজারজাত করা হয়। বছরে প্রায় ৩৯ লাখ ২০ হাজার বোতল ফরেন লিকার উৎপাদিত হয় এখানে। আর বাংলা মদের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৬ লাখ লিটার। যা দেশের
১৩টি বিক্রয় কেন্দ্র হতে বাজারজাত করা হয়।
এখানে উৎপাদিত স্পিরিটগুলো হচ্ছেঃ কান্ট্রি স্পিরিট, রেক্টিফায়েড স্পিরিট,ডিনেচার্ড স্পিরিট।দুই ধরনের ভিনেগার উৎপাদিত হয়ঃমল্টেড ভিনেগার,সাদা ভিনেগার।
এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে নিজস্ব কৃষি খামারে “কেরুজ জৈব সার” নামে পরীক্ষামূলক জৈব সারের উৎপাদন শুরু হয়েছে। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৭হাজার মেট্রিক টন। প্রতি কেজি সার ১০ টাকা দরে এই সার বিক্রয় করা হবে।
বাংলাদেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে একমাত্র কেরু এ্যান্ড কোম্পানিকে লোকসান গুনতে হয় না। এর লাভের প্রায় সম্পূর্ণটাই আসে এখানকার ডিস্টিলারি ইউনিট থেকে। টানা পাঁচ বছর ৬০ কোটি টাকা করে লাভ করছে এই প্রতিষ্ঠানটি।।[৪] ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানির মোট বিক্রি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪০০ কোটি টাকা ছাড়ায়। যার মধ্যে শুধু মদ উৎপাদন থেকে কোম্পানির আয় হয় ৩৬৭ কোটি টাকা এবং এতে মুনাফা হয় ১০০ কোটি টাকারও বেশি। বর্তমানে কেরু অ্যান্ড কোং-এর ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।[৬] এছাড়া বাংলা মদ দেশের ১৩টি সেন্টারে বিক্রি হয়।