সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:০০ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ শীতলক্ষ্যা নদী নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও রূপগঞ্জের পূর্ব-পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।
একদিকে বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী মোহনা অপরদিকে আর রূপগঞ্জের একেবারে পশ্চিম সীমানা ঘেঁষে রয়েছে বালুনদী।
এ নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জের শিল্পাঞ্চল ও কৃষি। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠলেও পশ্চিম তীর অর্থাৎ নদীর পূর্বাঞ্চলের অনেকাংশে ই কৃষিই উপজীব্য। মূলত শীতলক্ষ্যা নদীর পানি অবলম্বন করে এখানকার সব ধরনের কাজ পরিচালিত হয়।
আর এই শীতলক্ষ্যায় একটা সময় পানি ছিল টলটলে।
এমনটা বলছিলেন বন্দরের লক্ষন খোলা এলাকার আবদুল কাদির। তিনি বলেন, ‘অনেকে রোগ নিরাময়ের জন্য খেত এই নদীর পানি। একি সময় প্রচলিত ছিলো শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দিয়ে তৈরি হতো ইঞ্জেকশনের ‘ডিস্ট্রিল ওয়াটার।’
এখন খাওয়া তো দূরের কথা, শীতলক্ষ্যার পানি স্পর্শও করা যায় না। নদীপথে চলার সময় নাকে রোমাল চেপে রাখতে হয়।’ আর এই নদীতে নেই কোন জলজ প্রাণী। মাছ বলতে শুধু সাকার ফিস রয়েছে প্রচুর।
শীতলক্ষ্যা নদের তীরবর্তী গ্রামগুলোর লাখ লাখ মানুষের দুঃখ নদীর পচা পানি। নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জের কোল ঘেঁষে প্রবহমান দুই নদী এখন দূষণ-দখলে নিঃস্বপ্রায়।
নদের নয়ন জুড়ানো রূপ তার ক্ষয়ে যেতে শুরু করে দুই যুগ পূর্ব থেকেই। নদে এখন মাছ নেই। বেড়েছে মশার উপদ্রব্য। কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। সংকট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। বেড়েছে রোগ-বালাই। পচা পানির কটু গন্ধে তীরবর্তী মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে। বিপন্ন হয়ে গেছে পরিবেশ। বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। দূষণের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে নদ দখলের প্রতিযোগিতা।
পূর্ব থেকেই ভোরে আর বিকালে সতেজ হাওয়া খেতে নদীর দুই পাড়ে হাঁটাহাঁটি এলাকাবাসী। তাতে প্রফুল্ল হতো দেহ-মন। প্রবাদ আছে- ‘নদীপাড়ের হাওয়া, লাখ টাকার দাওয়া’। ওই প্রবাদ ফিকে হয়ে গেছে।
ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য পড়ে নদীর পানি এখন আলকাতরার মতো কালো। স্থানীয় লোকজন একে ডাকে ‘পচা’ পানি বলে।
সরেজমিনে গত কয়েকদিনে বন্দরের মদনগঞ্জ, লক্ষারচর, চর ঘারমোরা, চুনাভুরা, সুভকরদী, লেংটা পাড়া, আলী শাহরদী, কলাগাছিয়া, চর ধলেশ্বর ছাড়াও রূপগঞ্জের বালু নদের তীরবর্তী বালুরপাড়, নগরপাড়া, দাসেরকান্দি, বাবুরজায়গা, ফকিরখালী, বেরাইদ, নাগদারপাড়, গৌড়নগর, ত্রিমহনীসহ বিভিন্ন ঘুরে দেখা গেছে, এ যেন নাগরিক সভ্যতা ও আধুনিকতার ছোঁয়ার বাইরের জগৎ।
নারকীয় পরিবেশের সঙ্গে নদীর কালো পচা পানিতেই বৌ-ঝিরা থালাবাসন পরিষ্কার করছেন। কৃষক গরু-ছাগল গোসল করাচ্ছে। এমনকি লোকজন গোসল করছে এ পচা পানিতে।
শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে রয়েছে কিছু কৃষিজমি। এখানে বিভিন্ন রকমের ফসলের চাষ করেন স্থানীয় কৃষকেরা। পচা পানির কারণে এখন ফসলের উৎপাদন কমে গেছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।
বর্গাচাষী আহমদ আলী জানান, ‘আগে জমিনে বিঘায় ধান পাইতাম ৪০ মণ। অহন অয় ১৮ মণ ২০ মণ। পচা পানি খেতে দেওনে আলীর (চারার) গোড়া মোডা অইয়া যায়। ফলন অয় না। ’
এই বিশাল এলাকার দুই-তিন ফসলি জমি এখন পরিণত হয়েছে এক ফসলিতে। কৃষক মফিজ বলেন, ‘কারণ অন্য ফসল পচা পানিতে নষ্ট অইয়া যায়।’ বিকল্প না থাকায় তারা নদীর পচা পানি ব্যবহার করছেন জমিতে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে রূপগঞ্জ উপজেলার একজন কর্মকর্তা উল্লেখিত কৃষকদের বক্তব্য সমর্থন করে জানান, এই পচা পানির পুরো দ্বায় পরিবেশ অধিদপ্তরের। এই দপ্তরের দূর্ণীতি আর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তদ্বির বন্দ না করার কারণে নদীর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। আর এসব এলাকার কৃষিতে বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। পানিতে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকায় চারাগাছের গোড়া পচে যায়।
শীতলক্ষ্যা দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে দখলের প্রতিযোগিতাও। দখলদাররা নদীপাড়ে বাঁশের খুঁটি পুঁতে, গাছের ডালপালা ফেলে ছোপ (ঘের) তৈরি করে। বুঝানো হয় এখানে মাছ আটকানো হবে। পরে ধীরে ধীরে ওই ছোপের জায়গায় বালু ফেলে ভরাট করা হয়।
শীতলক্ষ্যার বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী মোহনা ও বালু নদের ডেমরা থেকে তুরাগের মোহনা পর্যন্ত দুই তীরে দখলের রামরাজত্ব চলছেই। নদীপাড়ের প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে বিশাল অঞ্চল।