বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৮ পূর্বাহ্ন
শাহজাহান আলী, কুড়িগ্রামঃ কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী আত্মগোপনে রয়েছেন, ভোগান্তিতে পরছেন নাগরিক সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ। প্রকাশ্যে না আসার বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায় নি।
স্থানীয় বিশেষ সূত্র জানা যায়, লিয়াকত আলী ১৮ ই জুলাই ছাত্রদের মারধরের ঘটনায় হুকুমের আসামি, কিছুদিন আগে ঐ ঘটনায় তার ভাতিজা হাসানুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাই গ্রেফতার এড়াতে আত্নগোপন করেছে চেয়ারম্যান।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, শুধু ছাত্রদের মারধরের ঘটনায় নয়, আরো অনেক অপরাধ ও দূর্নীতির সাথে জড়িত চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। কিছুদিন আগে লিয়াকত চেয়ারম্যানের দূর নীতির হলফনামা কিছু জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, চেয়ারম্যানের দূর্নীতির চিত্র এখন জনগনের সামনে আয়নার মতো। চেয়ারম্যান হিসেবে শুধু নয়, ছাত্রজীবন, কর্মজীবন সবখানেই তিনি রেখেছেন দূর্নীতির সুনিপুণ ছাপ। চাকুরী কালীন দূরনীতি করতে গিয়ে হাতে কলমে ধরা পড়ে হয়েছেন চাকুরীচ্যুত, চাকুরী কালীন দূর্নীতির মামলা এখনো চলমান। একজন দূর্নীতিবাজ চাকুরীচ্যুত ব্যাক্তিকে কিভাবে নমুনেট করলেন নির্বাচন কমিশন? লিয়াকত আলী চেয়ারম্যান হবার পরে থেকে দলদলিয়া ইউনিয়নে অনিয়ম আরও দূর্নীতি বেড়েই চলেছে। টি,আর প্রকল্প, কাবিখা, কাবিটা, এমপির বরাদ্দের কোটি কোটি অর্থ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে নামে বেনামি আত্মসাৎ করা হয়েছে। উপজেলা ভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ২৩-২৪ অর্থ বছর পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২৩-২৪ অর্থ বছরে অবকাঠামো ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প নামে প্রচুর পরিমাণ প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়। এ-ই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নামে মাত্র আর বাস্তবায়ন শুধু কাগজে কলমে। পুরো অর্থ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় মোট বরাদ্দে মাত্র ১০ শতাংশ কাজ হয়েছে, ৯০ শতাংশ গেছে ভোগের পেটে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাস্তবায়িত প্রকল্প গুলো পরিদর্শন করে দেখা যায়, একই প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেখিয়ে একাধিকবার প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। এ-ই চিত্র দলদলিয়া, থেতরাই, গুনাইগাছ, বজরা, তবকপুর, ধামশ্রেনী, হাতিয়া, বুড়া-বুড়ি সহ উলিপুর উপজেলার সকল ইউনিয়নেই। ২২-২৩ অর্থ বছরে দলদলিয়া ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডে ১ টি প্রকল্পের ব্যায় দেখানো হয়েছে ২ লক্ষ টাকা, সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায় ঐ প্রকল্পটি ৪নং ওয়ার্ড মেম্বারের বাড়ি সংলগ্ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ঐ মেম্বারকে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ঐ মেম্বার এ-ই প্রকল্প বিষয়ে কিছুই জানেনা। স্থানীয় সূত্র জানায় এখানে একদিন দুই তিন জন লোক এসে ৫/৬ ডালি মাটি ফেলছে, বলেছিল এটা একটা এনজিওর কাজ। এ-ই বিষয়ে তৎকালীন পিআইও অফিসের এক কর্মকর্তা দুলাল বলেন, এ-ই কাজ গুলো এরকমই হয়, আমাদের কিছু করার নাই।
২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় উপজেলা ভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার ৭৪,৭১৫,২৮৪/- (সাত কোটি ৪৭ লক্ষ পনেরো হাজার দুইশত চৌরাশি) টাকা নগদ অর্থ এবং ৬৬৬,৭৯৯৪ মে,ট, খাদ্য শস্য বরাদ্দ দেয়। তারমধ্যে দলদলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ পেয়েছে ৪,১৯,২,৩৭৭/- ( চার কোটি উনিশ লক্ষ দুই হাজার তিনশত সাতাত্তর) টাকা নগদ অর্থ এবং ৬০,৮৫২ মে,ট, খাদ্য শস্য।যার ১০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি, যেটুকু সংস্করণ হয়েছে তা উপজেলা মাটি কাটা প্রকল্পের আওতায়, তা দলদলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে বরাদ্দের ঐ অর্থ ও খাদ্য শস্য গেল কোথায়? শুধু টি,আর, কাবিখা নয়, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, গর্ভবতী ভাতা, ভিজিডি, প্রতিবন্ধী ভাতা,টিসিবি কার্ড সহ ইউনিয়ন ভিত্তিক সকল কার্যক্রমে রয়েছে দূরনীতির ছাপ, এটাই যেন দলদলিয়া ইউনিয়নের একমাত্র নিয়ম ও নীতি। আর এই অনিয়ম দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড বর্তমান দলদলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী সরকার ও তার ভাগিনা মাইদুল, ভাতিজা হাসানুর। এলাকার স্থানীয় সূত্র বলে লিয়াকত আলীর কাছে কোন কাজের জন্য গেলেই তিনি মাইদুল ও হাসানুরকে দেখিয়ে দিতেন এমন মনে হতো যেন মাইদুল এবং হাসানুরই হচ্ছে দললিয়া ইউনিয়নের অলিখিত চেয়ারম্যান। শুধু টি,আর, কাবিখা প্রকল্পই নয় নদী ভাঙ্গন প্রকল্পেও নামে বেনামে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ২৫ লক্ষাধিক টাকা। তথ্য অনুসন্ধানে আরো জানা যায় ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা অন্য মালিকের কাছে হস্তান্তর করতে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা, সূত্রমতে প্রায় ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা অন্য মালিককে হস্তান্তর করার জন্য আদালতে আবেদন করেন চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী সরকার। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় তিনি নিয়েছিলেন কপটতার আশ্রয়, নির্বাচন পরিদর্শনে যেনো প্রশাসন দ্রুত আসতে না পারে সেজন্য যোগাযোগের সড়ক কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করেছিলেন এবং ভোটকেন্দ্র দখল পূর্বক ভোট ছিনিয়ে নিয়েছেন মর্মে সত্যতা পাওয়া যায়। ২০২২-২৩ নদীভাংগন বরাদ্দ থেকে জনপ্রতি ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা নগদ সহায়তা কাগজে কলমে থাকলেও জনপ্রতি দেয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা। কারোর কারোর কাছে আবার এ-ই সুবিধা দেয়ার জন্য নেয়া হয়েছে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। চেয়ারম্যানের এ-ই অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত বর্তমান ইউপি সচিব বিশু যা স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
২০২২ এর নদী ভাঙ্গনের বরাদ্ধ সম্পর্কে ইউপি সচিব বিশ্বকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে আমি এ ব্যাপারে জানিনা, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। কিন্তু উক্ত প্রকল্পের কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে এবং স্থানীয় সূত্রের সাথে কথা বলে জানা যায় নদী ভাঙ্গনের বরাদ্দের পুরো প্রক্রিয়ায় ইপি সচিব বিশুর হাত দিয়েই সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে বিশু কেন তথ্য গোপন করলেন? তাহলে কি এ-ই অপরাধ সিন্ডিকেটে তারও অংশ রয়েছে এবং সেটি কতটুকু? বর্তমানে ৪ মাস থেকে চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী আত্নগোপনে রয়েছে, নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ, পোহাচ্ছেন ভোগান্তি। চেয়ারম্যান এর আত্নগোপন ও বিভিন্ন দূর্নীতির বিষয়ে জানতে ইউপি সচিব বিষুর সাথে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও সচিবের দেখা পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক এসেছে জানলেই তিনি অফিস থেকে বের হয়ে চা খেতে যান, ৩/৪ ঘন্টা সময় লাগে তার চা খেতে!!! সর্বোপরি ২০২-২৩ এবং ২০-২৪ অর্থ বছরে চেয়ারম্যান ও তার আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা মোট ৬,৬৯,২,৩৭৬/- ( ছয় কোটি ৬৯ লক্ষ ২ হাজার তিনশত সাতাত্তর) টাকা নগদ অর্থের প্রকল্প আত্মসাৎ করেছেন । উপজেলা ভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন শুধু মাত্র কাগজে কলমে দেখিয়ে প্রকল্পের কোন কাজ না করেই পকেট ভর্তি করেছে একটি গোষ্ঠী, তাদের মদদ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী।
তথ্যানুসন্ধানে বাস্তব চিত্রে পাওয়া যায়, একই প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প একাধিক নামে বা ভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে বরদা বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। দলদলীয়া, থেতরাই, গুনাইগাছ, বজরা, তবকপুর, ধামশ্রেবী,হাতিয়া, বুড়া-বুড়ি সবাই জায়গার চিত্র প্রায় একই। বিশেষ ভাবে উল্লেখিত দলদলীয়া খামার মাগুরা সরকার পাড়া ঈদগাহ মাঠ,সরকার পাড়া জামে মসজিদ, সরকার পাড়া কবরস্থান একই প্রতিষ্ঠান চারটি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কাশেমের বাড়ি থেকে খবরের বাড়ি, হাবিবের বাড়ি থেকে সজরুলের বাড়ি, আযহারের বাড়ি থেকে ফজলের বাড়ি, সাজুর বাড়ি থেকে শিরিনের বাড়ি, নুরুল মাস্টার এর বাড়ি থেকে মোহাম্মদীয় স্কুল, হাজীপাড়া থেকে দলদলীয়া বাজার, ইদ্রিসের দোকান থেকে পাতিলাপুর,নজির মাস্টার এর তেপতি থেকে ঘাটিয়াল পাড়া, হাজির তেপতি থেকে মহাদেব হিন্দু পড়া ক্লিনিক, সিরাজুলের বাড়ি থেকে সাহেবের বাড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। দলদলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক সূত্র জানায় রাস্তা ঘাটের যেটুকু কাজ হয়েছে তা উপজেলার মাটি কাটা প্রকল্পের, টি,আর,কাবিখা, কাবিটার কোন বরাদ্দ সম্পর্কে আমরা জানিনা, এ বিষয়ে চেয়ারম্যান কিংবা পিআইও কে জিজ্ঞেস করলে, বলতেন এখন কোন বরাদ্দ নাই, বরাদ্দ এলে জানতে পারবেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্র বলে আমরা পর্যবেক্ষণে যাইনি, তবে প্রশ্ন উঠে কিভাবে অর্থ ছাড় হলো? সেখানে সরকারি কোন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে ধাপে ধাপে যাচাই-বাছাই হয়? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি, শুধু বলেছে কি হয়েছে আমিও জানি, আপনারাও জানেন। নাম উঠে আসে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু, সাবেক এমপি এম, এ মতিন,, এমপির ছেলে মারজান,গবা পন্ডের ছেলে কোনিক ও তাঁর সহযোগীদের। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এসব ব্যক্তির সাথে লিয়াকত আলীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, লিয়াকত আলী প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে পকেট কমিটি গঠন করে, হাতিয়ে নেয় প্রকল্পের কোটি কোটি অর্থ, গড়ে তোলেন কালো টাকার পাহাড়। কয়েক মাস আগে ১৮ জুলাই ছাত্রদের মারধরের ঘটনায় আসামি দেখিয়ে চেয়ারম্যানের ভাতিজা হাসানুরকে গ্রেফতার করা হয়, এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছে লিয়াকত আলী চেয়ারম্যান।
নাগরিক সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগী জনগন বলেন, চেয়ারম্যান যদি পরিষদে না আসে, যদি আত্নগোপনে থাকতে চায়, তবে জনগনের দুর্ভোগ না বাড়িয়ে যেন পদত্যাগ করেন, তারপর যতোদিন ইচ্ছে আত্নগোপন করুক। ভুক্তভোগী জনতা জনদূর্ভোগ নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। কর্তৃপক্ষ যেন খুব শীঘ্রই দলদলিয়ার চেয়ারম্যান সংকট নিরসন করেন মর্মে প্রত্যাশা জ্ঞাপন করেন।