বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ১১:৫০ অপরাহ্ন
পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধিঃ রিমান্ডের ২য় দিনে আতিকুরের রহমানের দেয়া তথ্য শরীর থেকে মাথা আলাদা করতে ব্যবহৃত সেই ছুরি উদ্ধার করেছে পীরগঞ্জ থানা পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার চতরা ইউনিয়নের চারমাথা টেংরারদহ নামক স্থানে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর ডোবায় জমে থাকা পানি থেকে ওই ছুরি উদ্ধার হয়। এর আগে একই স্থানের পুর্বদিকে করতোয়া নদীর তীর থেকে গত শুক্রবার দেলোয়ারার মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি এম এ ফারুক জানান, মা ও মেয়ে হত্যাকান্ডে জড়িত আতিকুর রহমান মন্ডলকে তিন দিনের রিমান্ডে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ঠান্ডা মাথার খুনি আতিকুর স্পষ্ট তথ্য না দিলেও তার স্বীকারোক্তি মুলক তথ্যে খন্ডিত মাথা, মাথা খন্ডনে ব্যবহৃত ছুরি ও শিশু সাইমার লাশ মিলেছে।
আতিকুর জানান, দেহ থেকে মাথা আলাদা করার পর লাশ কাঁধে উঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। না হলে এই লাশ সে গায়েব করে ফেলতো। শিশু সাইমা অতিরিক্ত দুস্টামি করতো। দেলোয়ারার সাথে আনন্দ ফুর্তিতে বাধা ছিল। তাই দেলোয়ার অনুপস্থিতিতে দুস্টামির দন্ডে আঘাতে জ্ঞান হারানোর পর তাকে হত্যায় মায়া লাগেনি তার।
আতিকুর আরও জানান, দেলোয়ারা এতো বেশি মাদকাসক্ত ছিল, যার কারনে মাদকের লোভে যে কোন পুরুষে সাথে মেলা মেশায় তার রুচিতে আটকাতো না। এ কারনে রাগান্নিত ছিল আতিকুর। এছাড়াও দেলোয়ারা ও আতিকুরের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও ফুটেজ তৈরী করে দিনের পর দিন আতিকুরকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নিতো দেলোয়ারা। এমনকি দেলোয়ারাকে বিদেশ পাঠাতেও আতিকুরকে বাধ্য করেছে। সে কারনে আতিকুরের স্ত্রী মাধ্যমে জর্ডান যেতে দেড় মাস ধরে ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল দেলোয়ারা। দেলোয়ারাকে নেশার ছলে মরিচ ক্ষেতে নিয়ে অতিরিক্ত নেশা করিয়ে হত্যা করা হয়। ব্যবহৃত ছুরিটি উন্নত মানের লোহা দিয়ে ধারালোভাবে বানানো। এতে আরও অনেকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে জানান ওসি এম এ ফারুক।
উল্লেখ্য, রংপুরের পীরগঞ্জে দেলোয়ারার মাথাবিহীন লাশ এবং মাথা উদ্ধারের পর তাঁর মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। রোববার উপজেলার বড় বদনাপাড়া গ্রামের আতিকুর রহমান মন্ডলের বাড়ির পেছনে গর্ত থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত শুক্রবার বড় বদনাপাড়ায় এক নারী মরিচ তুলতে ক্ষেতে গিয়ে নারীর মাথাবিহীন লাশ পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে এসে পুলিশকে খবর দেন। সিআইডির ক্রাইম সিন দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় ও ঠিকানা শনাক্ত করে।
তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁর নাম দেলোয়ারা (৩১) বলে জানা সম্ভব হয়। নীলফামারীর জলঢাকায় তাঁর বাবার বাড়ি। শনিবার চতরা ইউনিয়নের করতোয়া নদীর তীরে পাকার মাথা টোংরারদহ এলাকা থেকে তাঁর কাটা মাথা উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বড় বদনাপাড়া গ্রামের আতিকুর রহমান মন্ডল ও তার মা আপিয়া বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসআই অনন্ত কুমার বর্মণ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। পুলিশের একটি দল বস্তা ও ব্যাগে থাকা ছবি, সিমকার্ড, কাগজে লিখিত কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বরের মাধ্যমে নিহত নারীর পরিচয় জানতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাঁর পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তাঁর নাম দেলোয়ারা। এর দুদিন পর তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে সাইমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।দেলোয়ারার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বড় বদনাপাড়া গ্রামের আতিকুর রহমান মন্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি দেড় মাস আগে দেলোয়ারার মেয়ে সাইমাকে হত্যার কথা পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।স্বজনরা দেলোয়ারার লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানালে শনিবার রাতে পুলিশের উদ্যোগে রংপুর সদরের মুন্সিপাড়া সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রোববার সাইমার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চলে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা আতিকুরের বাড়িতে ভাঙচুর,লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।নিহত দেলোয়ারার স্বামী ছিলেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দিলালপুর গ্রামের রেজাউল করিম। রেজাউল করিম পুলিশকে বলেছেন, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মেয়ে সাইমাও ছিল।
হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার আতিয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে, দেড় মাস আগে শিশুটিকে হত্যা করা হয়। লাশ লুঙ্গিতে পেঁচিয়ে বাড়ির পেছনে বাগানে গোবরের স্তুপের পাশে ৩-৪ ফুট গর্ত করে পুঁতে রাখেন তিনি।তাঁর স্বীকারোক্তির পর ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জায়গাটি থেকে শিশু সাইমার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
মামলার বাদী পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অনন্ত কুমার বর্মণ জানান, দেলোয়ারা যাত্রায় নাচের জন্য ‘ঝিনুক মালা’ নাম নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাত্রাদলের সঙ্গে থাকতেন। ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মা মারা যান, ভাই-বোনও ছিলেন না। মামা-মামি তাঁকে বড় করেন। ১২-১৩ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়ে যাত্রা দলে যোগ দেন তিনি। পরে বাড়ি ফিরলেও মামা-মামি তাঁকে আর গ্রহণ করেননি।রেজাউল করিম যাত্রা প্যান্ডেলে জুয়ার গুটিচালক (ডাবু) ছিলেন। সেখানে তাদের পরিচয়ের পর বিয়ে হয়। দেলোয়ারা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। আতিকুর রহমানও একই ধরনের কাজ করতেন। যাত্রায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দেলোয়ারার। পরিচয়ের পর তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে চলাফেরা করায় রেজাউল স্ত্রীকে তালাক দেন।এরপর থেকে আতিকুরের বাড়িতে থাকতেন দেলোয়ারা। ৪৫ দিন আগে দুষ্টুমি করায় শিশুটিকে আতিকুর আঘাত করেন। এতে সে চেতনা হারিয়ে ফেলে। পরে তাকে হত্যা করে মাটিতে পুতে রাখে।
ঘটনার সময় শিশুটির মা বাড়িতে ছিলেন না। যাত্রা থেকে ১৫-২০ দিন পর ফিরে দেলোয়ারা সন্তানের খোঁজ করলে আতিকুর বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। এর জেরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
প্রাথমিক তদন্তের এক পর্যায়ে আতিয়ারের গতিবিধিতে নজর রাখে পুলিশ। গত শনিবার সকালে বোরকা পরে পালিয়ে যাওয়ার পথে কাবিলপুর ইউপির ঘনশ্যামপুর সড়ক থেকে তাঁকে আটক করে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আতিকুরের মা আপিয়া বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ। শিশু সাইমার লাশ গুমের তথ্য গোপন রাখায় তাঁকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে মামলায়।
পুলিশ আদালতে ৭দিনের রিমান্ড চাইলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।